আসসালামু আলাইকুম মানব ইতিহাসের গভীরে লুকিয়ে আছে নানান ধর্ম, জাতি আর তাদের বিশ্বাস। আমরা জানি মোট আসমানি কিতাব ১০৪ খানা। যার মধ্যে ৪ খানা বড় তা হচ্ছে তাওরাত , যাবূর, ইন্জিল, কুরআন।   আজ আমরা এমন একটি বিষয় নিয়ে কথা বলব, যা শত শত বছর ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে – তা হলো তাওরাত কিতাব, বনী ইসরাইল এবং ইহুদি জাতিকে নিয়ে।

অনেকেই জানতে চান, তাওরাত কী, বনী ইসরাইল কারা, আর কেন ইহুদিরা আজো তাদের কিতাবকে আঁকড়ে ধরে আছে, যদিও ইসলাম বলে তা বিকৃত? চলুন, ইতিহাসের পাতা থেকে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বের করি।

প্রথমেই আসি তাওরাত-এর কথায়। তাওরাত, হিব্রু ভাষায় ‘তোরাহ’, মানে ‘আইন’ বা ‘নির্দেশনা’। ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, এটি আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক হযরত মুসা (আ.)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছিল বনী ইসরাইল জাতির জন্য। এটি ছিল তাদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান, যেখানে একত্ববাদ, আইন-কানুন, এবং নৈতিকতার শিক্ষা ছিল।

হযরত মুসা (আ.) একজন মুসলিম নবী ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে সকল নবী-রাসূলই (যেমন ইব্রাহিম, ইউসুফ, দাউদ, সুলাইমান, ঈসা এবং সর্বশেষ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর একত্ববাদ প্রচার করেছেন এবং তাঁরা সবাই মুসলিম ছিলেন।

তাওরাত কিতাব যাদের উপর নাযিল হয়।

তাওরাত অবতীর্ণ হয়েছিল বনী ইসরাইল জাতির জন্য। তারা ছিল হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর বংশধর, যাঁর আরেক নাম ছিল ইসরাইল। আল্লাহ তাদের ওপর অগণিত অনুগ্রহ করেছিলেন, অসংখ্য নবী পাঠিয়েছিলেন তাদের হেদায়েতের জন্য। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, তাওরাত পাওয়ার পরও এই জাতি বারবার পথভ্রষ্ট হয়েছে।

তাদের পথভ্রষ্টতার মূল কারণগুলো ছিল: নবী-রাসূলদের অবাধ্যতা (এমনকি তারা অনেক নবীকে হত্যাও করেছে), কিতাবের বিধান পরিবর্তন ও গোপন করা, দুনিয়ার প্রতি অতিরিক্ত মোহ এবং নিজেদেরকে ‘আল্লাহর মনোনীত জাতি’ ভেবে অহংকার করা। তারা একগুঁয়েমি ও ঝগড়াটে স্বভাবের কারণে আল্লাহর আদেশ অমান্য করেছে। কোরআনে বলা হয়েছে, তারা আল্লাহর কালামকে পরিবর্তন করে দিত।

বনী ইসরাইল জাতি থেকে যে ভাবে ‘ইহুদি’ নাম হলো

ইহুদি নামটি এসেছে হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর এক পুত্র, ইয়াহুদার (יְהוּדָה) নাম থেকে। তার বংশধরদের দ্বারা গঠিত যিহূদা রাজ্য-এর অধিবাসীদেরই মূলত ‘ইহুদি’ বলা হতো। পরবর্তীতে এই নামটি বনী ইসরাইলের সকলের জন্য প্রযোজ্য হয়ে ওঠে, বিশেষ করে যারা পরবর্তী নবী-রাসূলদের অস্বীকার করেছে।

বর্তমান ইহুদিরা যে তাওরাত অনুসরণ করে, তারা এটিকে তাদের ঐশী কিতাব এবং আইন-কানুন ও জীবনযাপনের মূল ভিত্তি হিসেবেই দাবি করে। তারা বিশ্বাস করে, এটি ঈশ্বর কর্তৃক মুসা (আ.)-এর মাধ্যমে প্রাপ্ত অপরিবর্তিত বাণী। তাদের দৈনন্দিন জীবন, ধর্মীয় রীতিনীতি এবং উৎসব-পার্বণ সবই এই তাওরাত কেন্দ্রিক।

তবে তাওরাত কিতাব নিজেদের বলে দাবি করলেও বা মেনে চললেও সেটি তাওরাত কিতাবের সঠিক রূপ নয় । তারা তাদের ইচ্ছা মত বিকৃত করে করে তাওরাত এর আসল বিষয় পরিবর্তন করে চলছে । 

তাহলে কেন মুসলিমরা বলে ইহুদিরা পথভ্রষ্ট? 

এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আসে: ইহুদিরা যদি তাদের কিতাব বিশ্বাস করে, তবে কেন তারা পথভ্রষ্ট? এর কারণ হলো:

১.  বিকৃত তাওরাত: মুসলিমদের বিশ্বাস অনুযায়ী, ইহুদিদের হাতে থাকা বর্তমান তাওরাত বা ‘তোরাহ’ মূল ঐশী তাওরাতের বিকৃত রূপ। মানুষের হাতে এর অনেক অংশ পরিবর্তিত হয়েছে বা হারিয়ে গেছে। ইহুদিরা একটি পরিবর্তিত কিতাবকে সম্পূর্ণ ও ঐশী মনে করে অনুসরণ করছে।

২.  পরবর্তী নবীদের অস্বীকার: এটিই মূল কারণ। ইহুদিরা হযরত ঈসা (আ.) এবং সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে নবী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। তাদের নিজেদের কিতাবেই শেষ নবীর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল বলে মুসলিমরা বিশ্বাস করে, কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছে।

৩.  কুরআনের সর্বজনীনতা ও চূড়ান্ত বিধান: ইসলাম বিশ্বাস করে, হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উপর অবতীর্ণ কুরআনুল কারীম হলো আল্লাহর সর্বশেষ, পূর্ণাঙ্গ ও সংরক্ষিত কিতাব, যা কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য হেদায়েত। কুরআন আসার পর পূর্বের সকল কিতাবের বিধানের কার্যকারিতা রহিত হয়ে গেছে। তাই, বর্তমান যুগে সকল মানুষেরই, ইহুদি-খ্রিস্টান নির্বিশেষে, কুরআনকে অনুসরণ করা উচিত।

সঠিক পথের আহ্বান 

তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইহুদিরা তাদের কিতাবকে বিশ্বাস করে এবং মানার দাবি করে, কিন্তু মুসলিমদের বিশ্বাস অনুযায়ী, তাদের সেই বিশ্বাস একটি বিকৃত কিতাবের প্রতি, এবং তারা সর্বশেষ নবীর আমন্ত্রণকে প্রত্যাখ্যান করেছে। যদি তারা মূল তাওরাত অনুসরণ করত এবং সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে মেনে নিত, তাহলে তারা সঠিক পথেই থাকতো এবং আজ মুসলিম উম্মাহর অংশ হতো।

ধর্ম মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য আসে। আল্লাহর সকল কিতাব ও নবীর মূল বার্তা ছিল একই – এক আল্লাহর ইবাদত এবং তাঁর নির্দেশের কাছে আত্মসমর্পণ। আশা করি, আজকের আলোচনা আপনাদের এই জটিল বিষয়গুলো বুঝতে সাহায্য করেছে।

Leave a Comment